আপনাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। তার আগে একটা গল্প বলি। আজমলের গল্প। আজমল শহরের একজন বিশিষ্ট মাদক ব্যবসায়ী। এমন কোন মাদকদ্রব্য নেই যা তার কাছে পাওয়া যায় না। তাই শহরে তার খদ্দেরের অভাব নেই। ধরুন প্রাপ্তবয়স্ক এবং উঠতি বয়স্ক মিলিয়ে শহরের শতকরা আশি শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরণের মাদক দ্রব্য সেবন করেন। এভাবে সব মিলিয়ে দুই বছর ব্যবসা করে সে অনেক টাকার মালিক হয়ে গেল। কিন্তু দুই বছর পার হতে না হতে এলাকায় বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিল। সমস্যাগুলি এরকমঃ
* এলাকার উঠতি/অপ্রাপ্ত বয়স্করা আজমলের কাছে গিয়ে মাদক নেয়া আরম্ভ করল।
* পুলিশ কখনও কখনও আজমলকে ধরে নিয়ে যেত এবং মারধোর করত।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে এলাকার অনেকেই যেহেতু মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে, তাই আজমলকে পুরোপুরি বাদ দেয়া যাচ্ছে না। আবার ঘরের উঠতি বয়স্করাও মাদকদ্রব্য গ্রহণে উৎসুক যেটা বড়রা ভাল চোখে দেখছেন না।
গল্পটা আপাতত শেষ। এবার আপনারা আমাকে একটা বুদ্ধি দিন কিভাবে আজমলের এই ব্যবসাটা বাঁচানো যায়, যাতে করে সে ব্যবসাটাও করে আর কোন সমস্যাও সৃষ্টি না হয়?
আপনারা বুদ্ধি দিন বা না দিন। আজমলের বন্ধু করিম তাকে একটা বুদ্ধি দিল। আমার মনে হয় বুদ্ধিটা আপনাদের পছন্দ হবে। করিম আজমলকে উপদেশ দিল সে যেন তার জমানো টাকা থেকে চালের ব্যবসা শুরু করে। চালের ব্যবসাটা শুধুমাত্র লোক দেখানো হবে। এতে করে পুলিশি সমস্যাগুলো কমে যাবে। সাথে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছেও ব্যাপারটা ধামাচাপা থেকে যাবে।
বুদ্ধিটা একেবারে ভাল না হলেও, এই বুদ্ধিতে এখনও পর্যন্ত আজমল ব্যবসা করে আসছে। আগের থেকে তার অবস্থা ভাল। পুলিশি ঝামেলাগুলো অন্তত সহনীয় পর্যায়ে আছে।
২
মাদক ব্যবসা শুরুর আগে আজমল নিজে মাদকাসক্ত ছিল। এর জন্য তাকে মারও খেতে হয়েছে। একবার অনেক রাতে মাতাল অবস্থায় বাসায় ফিরে আসার কারণে তার বাবা তাকে অনেক মেরেছিলেন। সেই রাতে যে চিৎকার টা সে দিয়েছিল, সেটা শুনে পাশের বাড়ি থেকে লোকজন চলে এসেছিলো। কিন্তু ততক্ষণে তার ক্ষতি যেটুকু হবার হয়ে গেছে। পা এর হাড় ভেঙ্গেছিল এবং কপাল কেটে গেছিলো।
এক সপ্তাহ হাসপাতালের বিছানায় অজ্ঞান থাকার পর তার জ্ঞ্যান ফিরল। জ্ঞ্যান ফিরেই সে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে। এক সপ্তাহ আগের যেই মারটা সে খেয়েছে সেই ঘোর এখনও তার কাটেনি। হাসপাতালের লোকজন এসে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করান।
স্থির হবার পর আজমল তার কপালের সেলাই করা কাটা দাগটা আঙ্গুল বুলাচ্ছে। হঠাৎ করে আজমল খেয়াল করল তার ভেতর আর নেশা কাজ করছে না। সে যে পর্যায়ের মাদকাসক্ত, এক সপ্তাহ পর নেশার টান কাজ না করাটা বেশ অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
আপনাদের কি মনে হয়, আজমল কি মাথায় আঘাত পেয়ে কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছে? নাকি তাকে অন্য কিছুর নেশায় পেয়েছে?
আচ্ছা, নেশা দিয়ে কি নেশাকে কাটা সম্ভব?
আমার জানামতে একটা নেশা আছে যেই নেশার কবলে পড়লে মানুষের কোন হিতাহিত জ্ঞ্যান থাকে না। হাসপাতালে বসে আজমল ঠিক করল, এখান থেকে বের হয়ে সে করিমের সাথে দেখা করবে।
হাসপাতালে আরো চারদিন থেকে সে সুস্থ হয়ে বের হল। পায়ের অবস্থা খুব একটা ভাল না। খুঁড়িয়ে হাটছে। ডাক্তার বলেছেন পা এর খুব বড় কোন ক্ষতি হয়নি। তবে সাবধানে চলাফেরা করে যেন।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আজমল সোজা করিমের বাড়ি চলে গেছে। করিম তো আজমলকে দেখে অবাক। করিম আজমলকে
নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসল। আজমল অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল। করিম তাকে এটা সেটা নানান কথাবার্তা জিগেস করছে। এরমধ্যে আজমল একটা অদ্ভুত কথা বলল, ‘আমার এই শহরটা চাই!' করিম কথাটা শুনে একটু থতমত খেয়ে গেল। ওষুধের ঘোর কাটে নি এরকম ভেবে করিম তাকে বিশ্রাম নিতে বলল।
আজমল চোখ পাকিয়ে করিমের হাত খপ করে ধরে বলল, ‘তোকে আমার লাগবে। তুই সাথে আছিস কিনা বল?' করিম এই কথা শুনে একবার আজমলের চোখে তাকালো। নাহ! এই চোখ সে আগে কখনও দেখে নি। এটা ঘোর লাগা চোখ না। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলা চোখ।
করিম আজমলের ঘাড়ে হাত রেখে একটা হাসি দিল। আজমল আর কিছু না বলে করিমের বাসা থেকে বের হয়ে বাড়ি চলে গেল।
৩
আজমলরা তিন ভাই দুই বোন ছিল। তার বাকী দুই ভাই ছিল ব্যবসাজীবি, বোনদের ভেতর একজনের বিয়ে হয়েছিল, অন্যজন এর বিয়ের ব্যাপারে তখন কথা চলছে। সব ছেলেমেয়ের ভেতর আজমল ছিল একরোখা এবং বদমেজাজী।
কোন একদিন আজমল বাসায় বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। হঠাৎ আজমলের বাবা এসে তার সামনে থেকে প্লেট গ্লাস সব ছুড়ে মারলেন। এরপরে শুরু করলেন অকথ্য ভাষায় গালাগালি এবং মারধোর। কেও একজন অভিযোগ দিয়েছে, আজমল স্টেশন প্লাটফর্মের পাশে বসে গাঁজা খাচ্ছিলো। আজমলের বাবা এই কথা শুনে সোজা বাসায় এসে তান্ডব লাগিয়েছেন। ওই সময় তার ভাইয়েরা কেও বাসায় ছিল না। বোনেরা এসে কোনরকম তাকে মারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এরকম ঘটনা মাঝেমাঝেই হত। মারধোর শেষে তার বাবা আক্ষেপ করতেন আজমলের মায়ের অকাল মৃত্যুর জন্য।
বাবার জন্য আজমলের ক্ষোভ ছিল। তার থেকেও বেশি ক্ষোভ ছিল শহরের মানুষগুলো কে নিয়ে। শহরে এত এত মানুষ এত খারাপ কাজ করে বেড়াচ্ছে আর সে কিছু খেলেই দোষ?
অনেকেই বলেন মা কে না পেয়ে হয়ত সে এমন হয়ে বেড়ে উঠেছে। বাড়ির ছোট ছেলে হিসেবে তাকে সবাই অনেক ভালবাসতো। কিন্তু তারপরেও সে ছোটবেলা থেকে ক্ষ্যাপা স্বভাবের ছিল।
এই স্বভাবের জন্য তার খুব বেশি বন্ধু ছিল না। শুধু করিম ই তার একমাত্র বন্ধু ছিল। করিমের নেশার অভ্যাস ছিল সীমিত। অভাবী ঘরের ছেলে হওয়ায় নেশার জোগাড় করতে আজমলের সাথে ঘুরতো। তবে কোথা থেকে কি কি মাদকদ্রব্য পাওয়া যেত তার সবকিছু সে জানতো।
-------------
এই পর্যন্ত এই অধ্যায় শেষ। আপনারা হতাশ হবেন জানি। তবে এই অধ্যায়ে আর কিছু লেখা হবে না। আজমল আর করিমের পরিকল্পনা আপনারা অনেকেই ধরে ফেলেছেন।
আজমলের সাহস, একগুঁয়েমি আর করিম মাদকের উৎস সম্পর্কে জানাশোনা, দুইয়ে মিলে মাদক ব্যবসা খুব সহজ একটা বিষয় ছিল।
কিন্তু মানুষ যা ভাবে তার সবকিছু কি পরিকল্পনা মাফিক হয়?
আপনাদের কি মনে হয়?