সেই রাতেঃ
রাত তখন ৩ টা বাজে। মিনহাজের হঠাৎ পানি পিপাসা পেলো। ডীম লাইটের আলোয় পাশের ছোট টেবিল হাতড়ে সে পানির একটা বোতল খুঁজে পেল । উঠে বসে পানি খেলো। পানি খাওয়ার সময় খেয়াল করলো তার মাথা ধরেছে। মাথায় এক হাত রেখে আরেক হাত দিয়ে পিছে হেলান দিতে গিয়ে টের পেলো কেউ একজন তার পাশে শুয়ে আছে। বাসায় আর কেউ থাকে বলে তার মনে পড়লো না।
ডীমলাইটের আলোয় বুঝতে পারলো এটা একটা মেয়ে। এলোমেলো বিশাল চুলে তার চেহারা ঢেকে আছে। মিনহাজ একটা চিৎকার দিতে গিয়েও দিলো না। তার মাথা ব্যাথার কারণ টা ততক্ষণে বের করতে পেরেছে। শীতের রাত, গা থেকে কম্বল সরে গিয়েছিলো। মাথা ব্যাথার সাথে গলা ব্যাথাও করছে অনেক। মিনহাজ কোনো কথা না বলে পাশে শুয়ে পড়লো। একবার ভাবলো চুলগুলো সরিয়ে চেহারা টা দেখে নেয়া দরকার মেয়েটা কে। কিন্তু তার আর সাহসে কুলালো না। সে আলাদা আরেকটা কম্বল আলমারী থেকে বের করে নিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়লো । ঘুমানোর আগে খেয়াল করলো মেয়েটার গা থেকেও কম্বল সরে গেছে। কি মনে করে মিনহাজ মেয়েটার গায়ে কম্বল তুলে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। আচ্ছা, এই মেয়েটা পরী টরী কিছু নয় তো? দাদীর কাছে সে শুনেছিলো পরীরা নাকি অনেক সময় এভাবে এসে শুয়ে বসে থাকে, আর তাদের ঝাঁকড়া চুল হয়।
পরের রাতেঃ
আবারও রাত ৩ টা। মিনহাজ তার মুখের উপরে ঝিরঝিরে একটা কিছু টের পেয়ে উঠে পড়লো। চোখ খুলে বুঝতে পারলো অনেকগুলি চুল তার মুখের উপরে পড়ে আছে। চুলগুলো সরিয়ে সে খেয়াল করলো একটা মেয়ে তার পাশে শুয়ে আছে। আজকে সে মেয়েটার মুখ দেখতে পারছে। আন্দাজ ৩০-৩২ বছরের একজন হবে। চিকন স্বাস্থ্য, উজ্জ্বল শ্যামলা। মিনহাজের কাছে মনে হচ্ছিলো সে এই মেয়েটাকে কোথাও দেখেছে। কোথায় দেখেছে, ঠিক মনে করতে পারলো না। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো। ঠিক দুঃস্বপ্ন না, হয়রানীমূলক স্বপ্ন। মেয়েটাকে ডাকবে কিনা বুঝে উঠতে পারলো না। মিনহাজের ভেতরে এক ধরণের মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। পানি খেয়ে আবারও সে ঘুমিয়ে পড়লো। এই মিশ্র অনুভূতির অর্থ কী?
তার পরের রাতেঃ
দেয়াল ঘড়িতে ২ টা বাজে। মিনহাজ খেয়াল করলো ঘড়িটা আর চলছে না। তার মানে ঘড়ির ব্যাটারি রাত ২ টায় শেষ হয়ে গেছে। মিনহাজ মনে মনে বললো, “ইদানীং ব্যাটারীতেও ভেজাল দেওয়া শুরু করেছে নাকি? কাল মকবুল মামাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে। কী সব ব্যাটারি বিক্রি করছে এগুলো একদিনের বেশি চলে না।” পানির বোতল হাতড়াতে গিয়ে বোতল পড়ে গিয়ে অনেক জোরে শব্দ হলো। সেই শব্দে মিনহাজের পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটা উঠে পড়লো। সে উঠে মিনহাজকে জিজ্ঞেস করল,
- কী হলো, এত রাতে কি করো?
- তুমি কে?
- আমাকে চিনতে পারছো না?
- না চিনতে পারছি না।
আচমকা মেয়েটা মিনহাজকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। পুরো ব্যাপারটা মিনহাজের কাছে গুলিয়ে যাচ্ছে। এরকম অবস্থায় মিনহাজের চেঁচিয়ে ওঠার কথা। কিন্তু তার কোনো একটা কারণে মেয়েটার প্রতি খারাপ লাগতে থাকে। তার কেনো জানি মনে হচ্ছে মেয়েটাকে সে চেনে। সে কোনো কিছু না জিজ্ঞেস করে বরং মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। আচ্ছা, এই মেয়েটা কি তাকে বশ-ফশ কিছু করেছে? ছোটবেলায় দাদীর কাছ থেকে শুনেছে এভাবে বশ করে নাকি অনেকে সংসার পর্যন্ত শুরু করে ফেলে।মিনহাজ আজকে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “এই মেয়ে, আপনি কি আমায় বশ করেছেন?”
অনেক অনেক রাত আগের কথাঃ
রিমি হঠাৎ করে একটা চিৎকার দিয়ে ছটফট করা শুরু করলো। বাসা ভর্তি লোকজন , বাইরে এ্যাম্বুলেন্স, সবাই তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে। রিমির বাচ্চা হবে। ডাক্তার যে তারিখ বলেছিলো তার থেকেও ১০ দিন আগেই তার ব্যাথা উঠেছে। রাত দেড়টা বাজে তখন। রিমির হাজব্যান্ড এ্যাম্বুলেন্সে করে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছে। হসপিটালে পৌঁছে ইমার্জেন্সিতে তার ওয়াইফকে ভর্তি করে ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য উপরে দোতলায় গেলো সে। খুব অল্প সময়ের ভেতর, খবর আসলো সবকিছু ঠিক আছে, এখন ডেলিভারী টা ঠিকঠাক হলেই হলো,কোন আলাদা জটিলতা নেই।
দোতলার বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। হঠাৎ করে একটা পাগল লোক তিন তলার ওয়ার্ড থেকে দৌড়ে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় । সবাই দ্রুত নিচে গেলে দেখে সে মাথায় একটা ভয়ানক আঘাত পেয়েছে। কপালের এক পাশ কেটে খুব বাজে ভাবে রক্ত পড়ছে। সবাই নিচে আসলে দেখা গেল একটা লোক চিৎকার করছে, “আমার রিমিকে বাঁচান!”
তার পরের রাত এর সকালেঃ
মিনহাজ একটা ছবি হাতে নিয়ে বসে আছে । সে কিছুই বুঝতে পারছে না। রাতে এমনিই তার ঘুম হয় নি। সকালে উঠে তার মকবুলের কাছে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সকালটা তার এরকম যাবে বুঝে উঠতে পারে নি। এই যে ছবি হাতে সে বসে আছে, সেটার হিসেবে তার বিয়ে হয়ে গেছে এবং ৮ বছরের একটি ছেলে আছে। ছেলেটা তার সামনে বসে সকালের নাস্তা করছে। সামনে বসে মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মিনহাজ কথা শুরু করলো,
- আপনি তাহলে আমার ওয়াইফ?
- (মেয়েটা মাথা নাড়ালো)
- আর এইটা আমাদের ছেলে?
- (মেয়েটা আবারও মাথা নাড়ালো)
- আর আমার মা?
- উনি মারা গেছেন ২ বছর হলো।
- তার মানে ঘড়ির ব্যাটারি অনেকদিন আগেই লাগানো হয়েছে, বুঝতে পেরেছি ঘড়ির ব্যাটারি একদিনে শেষ হয়েছে কীভাবে। আমি তো মকবুল মামাকে ভাবলাম যেয়ে বকা দেব।
- মামা ২ বছর হলো প্যারালাইজড, এখন উনার ছেলে দোকান দেখাশোনা করে।
খুব অসংলগ্ন কথা হলেও কেউ কিছু মনে করে নি। এগুলো গত ৮ বছর ধরে প্রতিদিন চলছে। এর আগে রিমি বারবার বলেছে তাকে “তুমি" করে বলতে। কিন্তু মিনহাজ কখনও তাকে “তুমি" করে বলতে পারে নি।
- আচ্ছা আমার আসলে হয় টা কী?
- রাত ৩ টার দিকে প্রতিদিন তোমার ঘুম ভেঙে যায়। এরপরে তোমার অনেক কিছুই মনে থাকে না।
- এটা কীভাবে হলো?
- একটা এক্সিডেন্টে। এমনেশিয়া , ডিমেনশিয়া মিলিয়ে ডাক্তার একটা নাম বলেছিলো, আমি নামটা উচ্চারণ করতে পারি না ঠিকমতো।
মিনহাজ কথা শেষ করে সারাদিন ঘরময় পায়চারী করলো। তার ছেলেটি যখন তাকে বাবা বলে ডাক দিচ্ছে ,সে তখন চমকে যাচ্ছে। তার একটু অস্বস্তি লাগছে। আবার ভালও লাগছে। মাঝে মাঝে সে মেয়েটাকে দেখছে, আজকে নাকি তাদের বিবাহ বার্ষিকী। মেয়েটা আজকে অনেক কিছু রান্না করছে। সারা বাড়ি একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে আছে।
--------------
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মিনহাজ তার ওয়াইফের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। রাতের ঘুমটা ভাঙলেই সব কিছু মুছে যাবে। এই মেয়েটাকে আর মনে থাকবেনা। আজকে মেয়েটা তাকে অনেক কিছু রান্না করে খাইয়েছে। বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেছে। এগুলো কিছুই তার মনে থাকবেনা।
সে এসব চিন্তা করতে করতে কিছু একটা বলতে যাবে , তখন মেয়েটা তার হাতের উপর হাত রেখে বললো, “ইটস ওকে! তুমি ঘুমাও।”
স্বীকারোক্তিঃ
রিমির বোন রাইসা রিমির বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। কোনো একটা কারণে রাইসা রিমিদের এলাকায় এসেছিলো, তাই ঘুরতে এসেছে। রাইসা- রিমি দের মধ্যে কিছু জটিলতা আছে। এটা শুরু হয় মিনহাজের এক্সিডেন্টের ৩ বছর পর থেকে। রিমিদের বাড়ি থেকে তাকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে চাপাচাপি করা হয়। মাঝখানে মিনহাজের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ ছিলো। ট্রিটমেন্ট করে উপসর্গ কিছুটা কমিয়ে আনলেও স্মৃতি ফিরিয়ে আনা যায়নি। এটা নিয়ে এখনও তাকে অনেক কথা শুনতে হয়। মিনহাজের পারিবারিক অবস্থা অনেক ভালো ছিল, এখনও আছে। কিন্তু আড়ালে আবডালে “পাগল জামাই"- কথাটা অনেকেরই হজম হয়নি। এতকিছুর পরেও রিমি কখনও হাল ছাড়েনি। মিনহাজকে ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে সে কখনও চিন্তাই করেনি। তাদের ছেলে জন্ম নেয়ার ৩ বছর পর শেষবার তাকে যখন জোর করে অনেক কথা শোনানো হয় তখন সে চেঁচামেচি করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। এরপরে কেউ আর তাকে জোর করেনি।
রাইসা ও রিমি ডাইনিং এ বসে কথা বলছে। মিনহাজ সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করে সে ডাইনিং রুমে এসে পড়লে রাইসাকে দেখে পর্দার পেছনে চলে যায়। রিমি খেয়াল করেছে রাইসাকে সে কোনো একটা কারণে পছন্দ করে না। রাইসা শুরু করলো,
- ভাই কি খবর?
- (মিনহাজ মাথা নাড়লো)
- ভাই কেমন আছেন?
- (মিনহাজ আবারও মাথা নাড়লো)
- দুপুরে খেয়েছেন?
- (মিনহাজ আবারও মাথা নাড়লো)
- (রাইসা একটু রাগ দেখিয়ে) কথা বলছেন না যে?
- (মিনহাজ পিছে ঘুরে অন্য রুমে চলে গেল)
রাইসা রিমির দিকে তাকিয়ে বললো, “এ তুই কী নিয়ে সংসার করছিস বলতো?” রিমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলো।
--------------
মিনহাজ সারাদিন মন খারাপ করে বসে ছিলো। রাইসার কথাটা মিনহাজের কানে গিয়েছে। সন্ধ্যায় রিমি যখন রুম গোছাচ্ছিলো তখন সে খেয়াল করল মিনহাজ মন খারাপ করে বসে আছে। রিমি মিনহাজের সামনে গিয়ে তার গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেসস করল,
- মন খারাপ?
- (মিনহাজ চুপ করে থাকলো)
- কী হয়েছে?
- আচ্ছা, আপনি এত গুলো বছর আমার সাথে কীভাবে আছেন? আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন না কেনো?
রিমি বুঝতে পারে রাইসার কথাগুলো সে শুনতে পেরেছিলো।
- (রিমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে) এই এতগুলো বছরে তুমি আমাকে মনে রাখোনি। আমার নামটাও তোমার মনে নেই। কিন্তু...এত বছরে... প্রতিদিন রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তুমি খেয়াল করে আমার গায়ে কাঁথা-কম্বল উঠিয়ে দাও। আমার এই যত্নটা কে করত বলো?
Dedicated to my Dadi